প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে বিশ্বদরবারে অন্যতম আস্থাভাজন দেশ জাপান। দেশটি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। সেটা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে বারবার প্রমাণিত হয়ে এসেছে। ১৯৭২ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে সেই সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক জাপান সফরের পর সেই সম্পর্ক স্থায়ী বন্ধুত্বে রূপ নেয়। জাপানের প্রতি বাংলাদেশীদের ইতিবাচক মনোভাবও প্রশংসনীয়।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি বিনিয়োগের প্রধান গেটওয়ে হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এ অঞ্চলে চীনের ক্রমশ আগ্রাসী বিনিয়োগ টোকিওকে দক্ষিণ এশিয়ামুখী হতে বাধ্য করেছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও বঙ্গোপসাগরীয় সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে জাপানের কাছে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ও টেকসই উন্নয়ন খাতে জাপানের রয়েছে বিস্ময়কর অবদান।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে রাজধানী ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাকে জরুরি ভিত্তিতে উন্নত করতে পদক্ষেপ নিতে জাপান সহায়তা করেছে। বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য বৃহত্তম দাতা হওয়ার পাশাপাশি, জাইকা পরিবহন খাতের ওপর জোর দিয়ে উল্লেখযোগ্য সহায়তা দিচ্ছে।
২০০৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত জাইকা স্থিতিশীল আঞ্চলিক সংযোগ তৈরির জন্য সেতু নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। এর মধ্যে যমুনা বহুমুখী সেতু (জাপানি ওডিএ, ডব্লিউবি, এডিবি দ্বারা অর্থায়ন), গোমতী সেতু, পাকশী সেতু, রূপসা সেতু, কাঁচপুর সেতু উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে উন্নত যোগাযোগের জন্য সেতু নির্মাণেও মনোযোগী ছিল জাপান।
ওডিএ বা আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা কর্মসূচির আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সহযোগিতা দিয়ে আসছে জাপান। বর্তমানে জাপানি ওডিএর সবচেয়ে বড় গন্তব্য বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে জাপানের মোট সহযোগিতার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪২৫ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটির কাছ থেকে আরো ২৬৩ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।
গত বছরের আগস্টে জাইকার সঙ্গে সরকারের একটি চুক্তি হয়। এখন পর্যন্ত ওডিএ কর্মসূচির আওতায় এটিই জাপান-বাংলাদেশের বৃহত্তম ঋণ চুক্তি। এর পরিমাণ প্রায় ৩২০ কোটি ডলার। জাইকার মাধ্যমে সাতটি সরকারি প্রকল্পে এ অর্থ ঋণ দিচ্ছে জাপান।
অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর তুলনায় বেশ শিথিল শর্তে বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে থাকে জাপান। বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সাম্প্রতিক স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তিগুলোয় সুদহার ধরা হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ। পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ বছর। এর সঙ্গে গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ধরা হয়েছে আরো ১০ বছর।
জাপানি অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায় নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থায়ন করছে জাইকা। বন্দরটি নির্মাণ হচ্ছে জাপানের কাশিমা ও নিগাতা বন্দরের আদলে। শুরুতে শুধু মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনা করা হলেও পরে তা সংশোধন করে এটিকে পূর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।
রাজধানীর সড়ক অবকাঠামোয় চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছে জাপানি বিনিয়োগ। এর মধ্য দিয়ে ঢাকায় গণপরিবহনের যাতায়াত উন্নয়নে গৃহীত ম্যাস রাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) প্রকল্প ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করতে চায় সরকার। মোট ১২৮ দশমিক ৫৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ (উড়াল ৬৭ দশমিক শূন্য ৬৯ কিলোমিটার এবং পাতাল ৬১ দশমিক ৪৭২ কিলোমিটার), ১০৩টি স্টেশন (উড়াল ৫১টি এবং পাতাল ৫২টি) বিশিষ্ট একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার এ প্রকল্প হাতে নেয় বাংলাদেশ সরকার। এ প্রকল্পে বড় বিনিয়োগ করছে জাইকা। এগুলো বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৯৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
দেশের অন্যান্য যোগাযোগ অবকাঠামোর মেগা প্রকল্পগুলোতেও বড় বিনিয়োগ রয়েছে জাইকার। যমুনা নদীর ওপর ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু। প্রকল্প ব্যয়ের ৭২ শতাংশ বা ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে জাইকা।
গত কয়েক বছরে দেশে জাপানি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাংলাদেশে চালু জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৭০টি। এক যুগ পর দেশে চালু জাপানি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২১টিতে। নামিদামি জাপানি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশে কারখানাও স্থাপন করছে।
এছাড়া বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট, সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিকল্পনা, কর্ণফুলী পানি শোধন, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ বা এফডিআই আকর্ষণের উদ্যোগ, স্বাস্থ্য পরিষেবা শক্তিশালীকরণ, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন, ঢাকার মেট্রোরেল, সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চল, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উল্লেখযোগ্য।
এর মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ভবন নির্মাণসহ যাবতীয় কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আজ এটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপান সরকারের ঋণ সহায়তায় বিমানবন্দরে এ তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিমান পরিবহনের চাহিদা পূরণ এবং আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নতুন টার্মিনাল ভবনটি অত্যাধুনিক, বিশ্বের উন্নত যেকোনো বিমানবন্দরের মতো সৌন্দর্যমণ্ডিত। এতে যাত্রীসেবার জন্য সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিমানবন্দরের বার্ষিক যাত্রী ধারণক্ষমতা ৮০ লাখ। প্রকল্পটি শেষ হলে প্রতি বছর নতুন করে সেবার আওতায় আসবেন আরো ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী। আন্তর্জাতিক রুটের সংখ্যা বাড়বে এবং বাংলাদেশের আকাশপথের সঙ্গে নতুন নতুন গন্তব্য যুক্ত হবে। এতে একদিকে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং পণ্য রফতানি বাড়বে। পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় প্রকল্পটিকে চলমান টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
নতুন টার্মিনালটি যাত্রীদের বিশ্বমানের সেবা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এই টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হওয়ার জন্য আগামী বছরের শেষ নাগাদ অপেক্ষা করতে হবে। টার্মিনাল পরিচালনায় ব্যবহৃত সরঞ্জামের প্রয়োজনীয় সামঞ্জস্য এবং প্রস্তুতির কারণে এ সময়ের প্রয়োজন। তবে আংশিক উদ্বোধনের পর তৃতীয় টার্মিনালের নতুন পার্কিং অ্যাপ্রোন ও ট্যাক্সিওয়ে ব্যবহার করতে পারবে এয়ারলাইনসগুলো। পুরনো দুটি টার্মিনালের হ্যাঙ্গারে বর্তমানে ২৯টি উড়োজাহাজ থাকতে পারে। ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের টার্মিনালটি পুরোপুরি চালু হলে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। নতুন টার্মিনালে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম, অ্যারাইভাল লাউঞ্জ, ক্যান্টিন, ডিউটি ফ্রি শপ ও বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে। অন্যান্য দেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য কাস্টমসের জন্য একটি হল ও ছয়টি চ্যানেল থাকবে। টার্মিনালটিতে ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার এলাকা থাকবে ভিআইপি যাত্রীদের সেবা দেয়ার জন্য।
প্রখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিনের নকশায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নতুন এই টার্মিনাল তৈরির জন্য জাইকা ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের। টার্মিনাল নির্মাণের কাজ করছে জাপানের মিৎসুবিশি, ফুজিটা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং।
জাপানের সহযোগিতায় পিপিপির ভিত্তিতে থার্ড টার্মিনালের অপারেশনাল ও হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে কোন পদ্ধতিতে কাজ হবে, পরিচালন ব্যয় কীভাবে খরচ হবে, আয়ের অর্থ কীভাবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) পাবে— এ বিষয়ে সমীক্ষা চালানো হচ্ছে।
জাপানি প্রতিষ্ঠান টার্মিনালটির গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা দেবে। এটা দেয়ার জন্য তারা বিনিয়োগ করবে। তবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের আদায় করা চার্জ থাকবে বেবিচকের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া প্রশাসনিক নিরাপত্তা, কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন নিজ নিজ বিভাগ পরিচালনা করবে।
২২ মার্চ বেবিচকের এক চিঠিতে বলা হয়, জাপানের আর্থিক সহায়তায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প কাজ চলমান, যা চলতি বছরের অক্টোবরে সফট ওপেনিং হবে। তৃতীয় টার্মিনালের অপারেশন এবং মেইনটেন্যান্স কাজ পরিচালনার জন্য সরকারের পাবলিক প্রাইভেট-পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক ইনভেস্টর নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অন্য এক চিঠিতে বলা হয়, এ প্রকল্পের আওতায় তৃতীয় টার্মিনালে যাত্রী হ্যান্ডলিংয়ে বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপিত হবে। এগুলো বুঝে নেয়া এবং অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স কাজ পরিচালনার জন্য বেবিচককে জনবল নিয়োগ করতে হবে। কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়েলকে নিয়োগ করা হয়েছে।
আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, জাপানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমাদের যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে আগামীতে টেকসই উন্নয়নে ফলপ্রসূ হবে। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটলে বহির্বিশ্বের বহুদেশ এখানে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে, যা দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে।
ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম: চেয়ারম্যান, জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
News Link: https://shorturl.at/TyeIg