জাপানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব: ঢাকা-টোকিও সামরিক সহযোগিতার দিকে ঝুঁকছে -ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন * চীনের সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না -মুন্সী ফয়েজ আহমেদ
জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ ঘোষণা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে বেশ আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশের চীনের দিকে হেলে থাকার যুক্তরাষ্ট্রের বরাবরের অভিযোগের বিপরীতে এটা পররাষ্ট্রনীতিতে আরও ভারসাম্য আনার চেষ্টা। আবার অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই নীতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। ফলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা যৌথভাবে দু’দেশের সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ হিসাবে ঘোষণা করেন। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরকালে দুই নেতা ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককেও ‘কৌশলগত অংশীদারত্ব’ বলে ঘোষণা করেন। ফলে জাপান হলো দ্বিতীয় দেশ যার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত হলো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরে সামরিক সহযোগিতা নিয়ে সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানিজ স্টাডিস ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, ঢাকা-টোকিও সম্পর্ক এখন সামরিক সহযোগিতার দিকে ঝুঁকছে। তবে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না।
ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক। ২০১৪ সালে জাপানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বাংলাদেশ সফর এবং ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপানে ফিরতি সফরের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্ক সাহায্য ও সহযোগিতার বাইরে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাপক অংশীদারত্বের সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়। তার অধীনে আড়াইহাজারে এক বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন’ (বিগ-বি) উদ্যোগ গ্রহণ করে জাপান। মহেষখালীর মাতারবাড়িতে নির্মিত হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। মাতারবাড়ি ঘিরে তিন হাজার থেকে চার হাজার কোম্পানি যুক্ত হচ্ছে। ২০২৬ সাল নাগাদ তার অনেক কিছুই দৃশ্যমান হবে। বাংলাদেশে জাপানের বাণিজ্য চীনের চেয়ে দ্রততম গতিতে বাড়ছে। এসব অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুরক্ষা দিতে নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে আসে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের সম্পর্কে চীনের দিকে হেলে পড়ার যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগে ভারসাম্য আনতে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত করা হয়েছে। তার সমর্থনে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে সই হয়েছে সামরিক চুক্তি।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিকের ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ফলে বাংলাদেশকে কোনো না কোনোভাবে এই ধারণায় যুক্ত করার তাগিদ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হলো, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের সমন্বয়ে চীনবিরোধী সামরিক জোট কোয়াডে বাংলাদেশকে যুক্ত রাখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সামরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির কৌশলগত সম্পৃক্ততা পরোক্ষভাবে হলেও চীনকে মোকাবিলার কৌশল হতে পারে।
ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন উল্লেখ করেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা গত মাসে ভারত সফরকালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্য পরিচালনার সুবিধা দেওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এখানেও নিরাপত্তার প্রশ্নটা এসে যায়। এসব কারণে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্রমশ সামরিক সহযোগিতার দিকে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের দু’বার যৌথ নেভাল এক্সারসাইজ হয়েছে। তাছাড়া, অফিসিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স (ওএসএ) নামে অস্ত্র দিয়ে সমর্থন দেওয়ার কর্মসূচি রয়েছে। তার অধীনে বাংলাদেশের বর্ধিত সমুদ্রসীমায় অবৈধ নৌচলাচল ও মাছ ধরা রোধ করতে জাহাজ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে জাপান। বাংলাদেশকে জাপান সাহায্য হিসাবে কিংবা যৌথ অর্থায়নে সামরিক সরঞ্জাম দেওয়ার প্রস্তাবও করেছে। ফলে গোটা প্যাকেজ চীনকে মোকাবিলার কৌশল বলে মনে হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগ চীন সরবরাহ করে থাকে। বাংলাদেশ এখন সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহে বহুমুখীকরণ করছে।
জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, জাপানের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব করার কারণে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্ক আগে থেকেই আছে। জাপানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক মানে তাদের সঙ্গে কোনো বলয়ে আমরা যুক্ত হচ্ছি না। বরং দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক আরও জোরদার হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য একটা কৌশল। এটা অন্য কারও বিরুদ্ধে নয়। জাপান সফরে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ ১৫ দফা ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকে তা স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থাপনা চায়। জাপান যাতে বাংলাদেশের ওপর নীতি চাপিয়ে দিতে না পারে সেই লক্ষ্যে আগেভাগেই এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগ চীন থেকে আমদানি করে। জাপানের সঙ্গে সামরিক চুক্তির কারণে এই নীতিতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের এই সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ এখনও চীন থেকেই বেশি অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করে। তবে এখন কিছু সামরিক সরঞ্জাম ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক থেকেও আমদানির বিষয় বিবেচ্য। এটা বাংলাদেশের একটা পলিসি। চীনের কাছ থেকে তাদের দেশের ঋণে অস্ত্র আমদানি করে বাংলাদেশ। পরে চীন অনেক সময় তা মওকুফ করে দেয়। এত সহজ শর্তে কেউ অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দিতে পারবে না। ফলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ সঠিক কাজ করেছে। পশ্চিমের দিকে হেলে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
News Link: https://shorturl.at/6tW9S